আলোকের বাতিঘর ছিলেন গোলাম কিবরিয়া
আলী বেবুল
প্রকাশিত হয়েছে : ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২২, ১১:৪৭ মিনিটএকজন আলোকিত ব্যক্তিত্ব গোলাম কিবরিয়া। বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী। বিয়ানীবাজার উপজেলার শিক্ষা, শিল্প-সাহিত্য, সংস্কৃতি, ক্রীড়া ও সুস্থধারার রাজনীতির চর্চা ও বিকাশে তাঁর ছিল অনবদ্য ভূমিকা। তারুণ্যের শুরুটা তাঁর একজন ফুটবল খেলোয়াড় হিসেবে। ছিলেন একজন ভালো গোলরক্ষক।ফুটবল মাঠে তাঁর পরিচয় ছিল সেলিম হিসেবে।
বিগত শতকের আশির দশকে বিয়ানীবাজার উপজেলা ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতির দায়িত্ব পালনকালে স্বৈরাচার বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে রেখেছিলেন অগ্রণী ভূমিকা। একজন পরিচ্ছন্ন ছাত্রনেতা ও সুবক্তা হিসেবে তাঁর পরিচিতি ছিল। এ প্রসঙ্গে একটি ঐতিহাসিক তথ্য উল্লেখ করতে চাই। ১৯৮৬ সালে স্বৈরশাসক এরশাদের আমলে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। সিলেট-৬ আসনে জাতীয় পার্টির প্রার্থী ছিলেন ব্যারিস্টার আব্দুল হাসিব। তাঁকে বিয়ানীবাজারে অবাঞ্চিত ঘোষণা করা হয় তৎকালীন সরকারবিরোধী ১৫ দলীয় জোট ও ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে। জাতীয় পার্টির প্রার্থী বিয়ানীবাজারে শেষ নির্বাচনী সভা করতে গেলে প্রতিরোধের মুখে পড়েন। ১৫ দলীয় জোট ও ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ভঙ্গ করে দেয়। ছাত্র-জনতার তীব্র বাঁধার মুখে জাতীয় পার্টি বিয়ানীবাজারে কোন সভা করতে পারেনি। এ সময় ব্যারিস্টার হাসিবের পক্ষ থেকে বিয়ানীবাজারের ১৫ দলীয় জোট ও ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের প্রায় ৪০জন নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়। গোলাম কিবরিয়া ছিলেন এ মামলার অন্যতম আসামী। স্থানীয় ভাবে এ মামলা ‘লাঙ্গল ভাংগার কেইস’ হিসেবে পরিচিত ছিল।
বাগ্মী ও মুক্ত চিন্তার মানুষ গোলাম কিবরিয়ার সঙ্গে আমার পরিচয় হয় ১৯৮৫ সালে, বিয়ানীবাজারের ফরিদ উদ্দিন আহমদ নিউজ পেপার এজেন্সীতে। আমি তখন পঞ্চখন্ড হরগোবিন্দ উচ্চ বিদ্যালয়ের ৮ম শ্রেণির ছাত্র। পেপার এজেন্সী তখন ছিল পোস্ট অফিস রোডে। প্রায় প্রতিদিনই স্কুল থেকে সহপাঠি ও বন্ধু টিপুর (পেপার এজেন্সীর বর্তমান পরিচালক আব্দুল বাসিত টিপু) সাথে সেখানে যেতাম। পেপার এজেন্সি একসময় ছিল বিয়ানীবাজারের মুক্ত চিন্তার মানুষের আড্ডাস্থল। সংবাদ পিপাসু রাজনীতিবিদ, ছাত্র-শিক্ষক, ব্যবসায়ী, সাংবাদিক ও সংস্কৃতি কর্মীদের মিলন মেলায় পরিণত হতো। অধ্যাপক মাহবুবুর রশীদ চৌধুরী, আব্দুস সাত্তার, গোলাম কিবরিয়া, কবি ফজলুল হকসহ অন্যান্যদের উপস্থিতিতে বিভিন্ন বই ও সমসাময়িক বিষয় নিয়ে অসংখ্য প্রাণবন্ত আলোচনার শ্রোতা হওয়ার সুযোগ হয়েছিল।
‘৮৮ সালে বিয়ানীবাজার কলেজে উচ্চ মাধ্যমিক লেখাপড়া করার সময় গোলাম কিবরিয়ার সংস্পর্শ পাওয়ার সুযোগ হয়। তিনি তখন এ কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের প্রভাষক। দেখেছি তাঁর ক্লাসে লেকচার শুনার জন্য শিক্ষার্থীদের উপচে পড়া ভিড় ছিল। কিবরিয়া স্যারের লেকচার কোন শিক্ষার্থী মিস করতে চাইতেন না। একজন জনপ্রিয় শিক্ষক হিসেবে ক্যাম্পাসে তাঁর একটি পরিচিতি ছিল।
উচ্চ মাধ্যমিকে পড়াশুনার সময় সাংবাদিকতায় যুক্ত হই। তখন গোলাবিয়া লাইব্রেরি ছিল স্থানীয় কর্মরত সাংবাদিকদের সংগঠন বিয়ানীবাজার প্রেস ক্লাবের অস্থায়ী কার্যালয়। তখনকার সময়ে প্রতিদিন সন্ধ্যায় বই পড়ুয়াদের আড্ডা হতো গোলাবিয়া লাইব্রেরিতে। সংবাদকর্মী, সংস্কৃতিসেবী, রাজনীতিবিদ ও ছাত্রনেতাদের পদচারণায়মুখর হয়ে উঠতো গোলাবিয়া লাইব্রেরি। গোলাম কিবরিয়া প্রায়ই আসতেন লাইব্রেরি। সেই সময়ের আড্ডার তিনি ছিলেন অন্যতম প্রাণ পুরুষ। এছাড়া আল আমিন প্রেসে বিভিন্ন আড্ডা জমে উঠতো, সেখানেও তিনি থাকতেন। এ সময়ে তাঁর সাথে আরো ঘনিষ্ঠ হওয়ার সুযোগ হয়। এরপর রাজনীতি, সাংস্কৃতিক ও ক্রীড়াসহ বিভিন্ন সামাজিক কর্মকান্ডে তাঁর সাথে প্রত্যক্ষভাবে কাজ করি।
নব্বইয়ের গণ আন্দোলনের সময় তিনি খুবই সক্রিয় ছিলেন। ৮ দলীয় জোটে প্রতিনিধিত্ব করতেন কমিউনিস্ট পার্টির নেতা হিসেবে। নব্বইয়ের দশকের প্রথম দিকে স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধবিরোধী পাক-বাহিনীর দালাল খুনি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে ‘ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটি’ গঠিত হলে বিয়ানীবাজারে ওই আন্দোলন সংগঠিত করাসহ নব্বইয়ের দশকে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ও চেতনা পুনরুজ্জীবিত করার ঐতিহাসিক সংগ্রামে বিশিষ্ট ভূমিকা পালন করেন।
১৯৯১ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সিলেট-৬ ( গোলাপগঞ্জ- বিয়ানীবাজার) আসনে ৮ দলীয় জোটের মনোনীত প্রার্থী হিসেবে নৌকা প্রতীক নিয়ে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক নুরুল ইসলাম নাহিদ। সে সময় নাহিদ ভাইয়ের পক্ষে নির্বাচনী প্রচারণায় গোলাম কিবরিয়া ছিলেন একজন সক্রিয় রাজনীতিবিদ। সেই নির্বাচনে গণসংযোগের কাজে গোলাপগঞ্জ থেকে বিয়ানীবাজার ফেরার পথের একটি ঘটনা আজ মনে পড়ছে। শেওলা ফেরীঘাটে প্রায় ৫ ঘন্টা নাহিদ ভাই, কিবরিয়া ভাই, দৌলা চাচা (ফখরু দৌলা, আওয়ামীলীগ নেতা, প্রয়াত), খয়ের ভাই (আবুল খয়ের চৌধুরী, বীর মুক্তিযোদ্ধা, তৎকালীন উপজেলা ন্যাপের সাধারণ সম্পাদক) ও আমি আটকা পড়েছিলাম। তখন শেওলা সেতু হয়নি। শেওলায় কুশিয়ারা নদীর উপর ফেরী দিয়ে বিয়ানীবাজার-সিলেট এর একমাত্র সড়ক যোগাযোগ ছিল। সকাল ৬ টা থেকে রাত ১২ টা পর্যন্ত ফেরী চালু থাকতো। রাত ১২ টার পর জরুরী কোন কারণে শেওলা ফেরী পারাপার হতে হলে ফেরীর চালক অর্থাৎ সারেংকে ঘুম থেকে জাগিয়ে অনেক অনুরোধ ও বকশিশ দিয়ে পারাপার হতো হতো। এরকম উদ্ভুত পরিস্থিতিতে কোন প্রভাব প্রতিপত্তি কাজে আসতো না। সারেং এর সাথে সু-সম্পর্ক ও বিনয়ের সাথে অনুরোধ জানালে উদ্বার পাওয়া যেত। বিপত্তি ঘটতো আনাড়ি কোন সারেং অথবা ঘাট পরিবর্তনের কোন কাজ হলে। গাড়ী নিয়ে বসে থাকতে হতো ফেরীঘাটে। এরকম একটি পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছিলাম আমরা সেদিন। গোলাপগঞ্জে গণসংযোগ শেষে গাড়ী নিয়ে রাত প্রায় ১ টায় শেওলা ফেরীঘাটে এসে উপস্থিত হই। সড়ক ও জনপথ (সওজ) বিভাগ ওই রাতে শেওলা ফেরীঘাট পরিবর্তন করে। কুশিয়ারা নদীর পানি কমে যাওয়ার কারণে বছরে ২/৩ বার সওজ এভাবে ঘাট পরিবর্তন করে। কোন বিকল্প ব্যবস্থা না থাকায় ফেরীঘাটেই গাড়ীর মধ্যে আমাদের রাতযাপন করতে হয়। তখন আজকের যুগের মতো কোন মোবাইল ফোন ছিল না। ফেরীঘাটে দিনের বেলা যে জনসমাগম ও চায়ের দোকানগুলো খোলা থাকতো, রাতের বেলা তার কিছুই থাকতো না। একটি অনাকাংখিত পরিস্থিতির মধ্যে গাড়ীর মধ্যে ৫ ঘন্টা কাটাতে হয়। নাহিদ ভাই, কিবরিয়া ভাই, দৌলা চাচা ও খয়ের ভাইয়ের রাজনৈতিক জীবনের স্মৃতিচারণমূলক নানা গল্প ও ইতিহাস শুনে শুনে সময় দ্রুত চলে যায়। ভোর ৬ টার মধ্যে প্রস্তুত হয়ে যায় ফেরীর নতুন ঘাট। ভোরের আলোয় আমরা চলে আসি গন্তব্যস্থলে।
নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি সময়ে গোলাম কিবরিয়া ছিলেন বিয়ানীবাজার উপজেলা ক্রীড়া সংস্থার সাধারণ সম্পাদক। আমি তখন বিয়ানীবাজার মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের কর্মকর্তা ও ধারাভাষ্যকার হিসেবে বিয়ানীবাজারের ক্রীড়াঙ্গনে তাঁর সাথে কাজ করেছি খুবই ঘনিষ্ঠভাবে। একজন দক্ষ ক্রীড়া সংগঠক হিসেবে তাঁর অনেক সুনাম ছিল।
১৯৯৫সালে বিয়ানীবাজারে স্বাধীনতার রজত জয়ন্তী উদযাপন কমিটি গঠন করা হলে তিনি ছিলেন এ কমিটির অন্যতম সংগঠক। এ কমিটির সাথে যুক্ত থাকায় কিবরিয়া ভাইয়ের সাথে কাজ করার সুযোগ হয়।
সত্যি কথা কিবরিয়া ভাই ছিলেন একজন অসাধারণ মানুষ। একজন আলোকিত ব্যক্তিত্ব। আলোকিত বিয়ানীবাজারের জন্য তাঁর অবদান চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।
নোটঃ পঞ্চখণ্ডের ভূমিপুত্র ও সিলেট শিক্ষা বোর্ডের প্রাক্তন চেয়ারম্যান অধ্যাপক একেএম গোলাম কিবরিয়া তাপাদারের জীবদ্দশায় তাঁকে নিয়ে ‘উৎসারিত আলো ‘ নামে পঞ্চখণ্ড গোলাবিয়া পাবলিক লাইব্রেরির উদ্যোগে স্বনামধন্য সাংবাদিক আজিজুল পারভেজের সম্পাদনায় একটি সম্মাননা গ্রন্হ প্রকাশিত হয়েছিল ২০২১ সালে। এ লেখাটা সেই বইয়ে প্রকাশিত হয়েছে । উল্লেখ্য, বরেণ্য এই ব্যক্তিত্ব গত ১৬ সেপ্টেম্বর ইন্তেকাল করেন।
https://utsaritoalo.ueuo.com/