আলোটুকু-ভালোটুকু দাও
ডা. মামুন আল মাহতাব (স্বপ্নীল)
প্রকাশিত হয়েছে : ০৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ৫:০৮ মিনিটদ্বাদশ জাতীয় সংসদে তেহাত্তরের জাতীয় সংসদের পর আমরা আবারও পেয়েছি শতভাগ রাজাকারমুক্ত একটি সংসদ। সেখানে যারা জিতে এসেছেন তারা যেমন স্বাধীনতার সপক্ষীয়, তেমনি যারা হেরে গেছেন তারাও। বাঙালি আর বাঙালিয়ানার এই বিশাল বিজয়কে উদযাপনেই দেশের লিভার বিশেষজ্ঞদের এই বাঙালীপনা
শীতের রাতে বিমানবন্দর রেল স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে মশার কামড় খাওয়াটাও কেন যেন দারুণ সুখকর মনে হচ্ছে! শীতের মাঝে অত রাতে স্টেশনে দাঁড়িয়ে মশার কাছে গোটাবিশেক লিভার বিশেষজ্ঞের স্বেচ্ছায় আত্মসমর্পণের কারণটা অবশ্য দারুণ। কক্সবাজার এক্সপ্রেসে চড়ে সেই রাতে আমাদের সবার গন্তব্য কক্সবাজারের সদ্য নির্মিত আইকনিক রেল স্টেশন। যাদের বাসা শহরের ওদিকটায়, এমনি আরও জনাত্রিশেক বর্তমান আর হবু লিভার বিশেষজ্ঞ ট্রেনটিতে চেপেছেন কমলাপুর থেকে।
দলবেঁধে আমাদের গন্তব্য এই যে কক্সবাজার, তার পেছনে কারণ কিন্তু একাধিক। আমরা ছুতো-নাতায় ফাঁক পেলেই কক্সবাজারে ছুট লাগাই। এটি অবশ্যই বড় একটা কারণ। তবে কারণ ছিল আরও। চিকিৎসকদের বরাবরই একটা বদনাম, আমরা অনেকেই চিকিৎসার বাইরের জগৎটা সম্বন্ধে খুব একটা খোঁজখবর রাখি না। কথাটা যে পুরোপুরি ঠিক নয়- আমরাও যে উপভোগ করতে জানি কক্সবাজারকে আর উপলব্ধি করতে পারি বঙ্গবন্ধু কন্যার হাতের জাদুর স্পর্শে বদলাতে থাকা বাংলাদেশটাকে, নতুন তৈরি রেললাইন ধরে, সদ্য আনা ট্রেনের কমপার্টমেন্টে চেপে কক্সবাজারের আইকনিক স্টেশন অভিমুখে আমাদের এই অভিযাত্রার সেটিও একটা বড় কারণ।
রাতভর কক্সবাজারের ট্রেন যাত্রায় আমরা ট্রেনেই একটি বৈজ্ঞানিক অধিবেশনের আয়োজন করেছিলাম। বৈজ্ঞানিক অধিবেশন বলতে যাকে বলে একেবারে ঠিকঠাক মতো একটি বৈজ্ঞানিক অধিবেশন আর কি! ছিলেন কি- নোট স্পিকার, সঙ্গে সেশন চেয়ার, মডারেটর আর পাওয়ার পয়েন্ট প্রেজেন্টেশন। সেশন শেষে ছিল প্রশ্নোত্তর পর্বও। লেকচারের বিষয়বস্তুটাও বদলে যাওয়া বাংলাদেশের সঙ্গে যথেষ্ট মানানসাই, ‘দেশে উৎপাদিত ইমিউনথেরাপি ব্যবহার করে লিভার ক্যান্সারের চিকিৎসা।’
ট্রেনে এ ধরনের বৈজ্ঞানিক অধিবেশন সম্ভবত দেশে এটাই প্রথম। উত্তর কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট ট্রেনে চেপে রাশিয়া ভ্রমণে গিয়েছিলেন। উত্তর কোরিয়াতেও ট্রেনে এমনি কোনো বৈজ্ঞানিক অধিবেশন হয়েছে কি না, আমার জানা নেই। ট্রেনে এই অভিনব অধিবেশনটি করার একটা বিশেষ উদ্দেশ্য আমাদের ছিল। আমাদের যে সময়টায় ট্রেনে চেপে কক্সবাজার যাত্রা, তখন দেশজুড়ে চলছে বিএনপি-জামায়াতের নেতৃত্বাধীন জঙ্গি জোটের সোকল্ড অসহযোগ আর মাঝেসাঝেই ট্রেনে আগুনসন্ত্রাস। ট্রেনে মানুষকে পুড়িয়ে মারার এই যে অভিনব অগ্নিসন্ত্রাস, তারই প্রতিবাদে আমরা লিভার বিশেষজ্ঞরা সে রাতে আয়োজন করেছিলাম ট্রেনে এই অভিনব বিজ্ঞানচর্চা।
কক্সবাজার যাত্রার সপ্তাহখানেকের মধ্যেই দেশে অনুষ্ঠিত হয়েছে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। গণমানুষের প্রত্যাশিত অংশগ্রহণে বাংলাদেশ পেয়েছে গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতায় আরও একটি নির্বাচিত সংসদসহ নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের। নতুন সংসদ সদস্য আর মন্ত্রিসভার শপথ গ্রহণের পর পরই আমরা আয়োজন করেছিলাম পিঠা উৎসবের।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের নবনির্মিত সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতালটির মনোরম পরিবেশে, হাল্কা যন্ত্র সংগীতের ব্যাকগ্রাউন্ডে দেশীয় আর রবীন্দ্র সংগীতের পরিবেশনায় ছন্দে-আনন্দে লিভার বিশেষজ্ঞ ছাড়াও অন্যান্য বিশেষজ্ঞ আর সিভিল সোসাইটির ডাকসাইটে অনেকের অংশগ্রহণের সে কি দারুণ এক পরিবেশ! ‘নতুন বছরে আলোটুকু দাও, ভালোটুকু দাও’ আপ্তবাক্যটিকে অন্তরে আর ব্যানারে ধারণ করেছিল এবারের পিঠা উৎসব।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদে তেহাত্তরের জাতীয় সংসদের পর আমরা আবারও পেয়েছি শতভাগ রাজাকারমুক্ত একটি সংসদ। সেখানে যারা জিতে এসেছেন তারা যেমন স্বাধীনতার সপক্ষীয়, তেমনি যারা হেরে গেছেন তারাও। বাঙালি আর বাঙালিয়ানার এই বিশাল বিজয়কে উদযাপনেই দেশের লিভার বিশেষজ্ঞদের এই বাঙালিপনা। সংসদ সদস্যদের জাতি নির্বাচিত করেছে অনেক বেশি আর অনেক বড় প্রত্যাশার জায়গা থেকে। তাদের কাছে গোটা জাতির মতো আমাদেরও একটাই প্রত্যাশা- ‘আলোটুকু দাও, ভালোটুকু দাও’!
আমাদের বিশ্বাস আছে, তারা তা দেবেনও। কারণ তারা-আমরা-আমরাই তো বাংলাদেশ! আর ওই যে যারা কথায় কথায় আগুন জ্বালায় আর পোড়ায় মানুষ, ওরা তো বাংলাদেশের উচ্ছিষ্ট। ওরা বাংলাদেশে থাকতে চায়, থাক। কিন্তু আমাদের আলোটুকু আর ভালোটুকু দেওয়ার যোগ্যতা যাদের নেই, তাদের এতটুকুও অধিকার নেই আমার-আপনার-আমাদের ভবিতব্য নির্ধারণের। আমার-আপনার-আমাদের ভোটে নির্বাচিত হয়ে পবিত্রতম জাতীয় সংসদকে আবারও কলঙ্কিত করার!
লেখক : অধ্যাপক, ডিভিশন প্রধান, ইন্টারভেনশনাল হেপাটোলজি ডিভিশন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ^বিদ্যালয় ও সদস্য সচিব, সম্প্রীতি বাংলাদেশ।