লোক সংস্কৃতি রক্ষার দায়িত্ব সবার,কারণ এটা আমাদের ভাষার ঐতিহ্য,, ড,অমলেন্দু ভট্টাচার্য
অরুপ রায়, করিমগনজ :
প্রকাশিত হয়েছে : ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ১:০২ মিনিট
লোক সংস্কৃতির লোক বলতে নির্দিষ্ট ভুগলে একই ভাষাভাষী ও একই জীবন দর্শনে বিশ্বাসী এক জনগোষ্ঠীকে বুঝায় । অর্থাৎ লোক সংস্কৃতি কেবল মাত্র আত্মপরিচয় নয় বরং সংস্কৃতি ও ভূগোলের চিহ্নের পরিচায়ক বলে মন্তব্য করেন বিশিষ্ট লোক সংস্কৃতি গবেষক ও লেখক ড.অমলেন্দু ভট্টাচার্য । দীর্ঘ সতেরো বছর পর করিমগঞ্জের লঙ্গাইঘাট এলাকায় বরাক উপত্যকা বঙ্গ সাহিত্য ও সংস্কৃতি সম্মেলনের লঙ্গাই মাইজগ্রাম ও কর্নমধু আঞ্চলিক সমিতির উদ্যোগে দুই দিবসীয় লোক উৎসবের আয়োজন করা হয়েছে । প্রদীপ প্রজ্জ্বলন করে এই উৎসবের সূচনা করেন বিশিষ্ট লোক সংস্কৃতি গবেষক ও লেখক ড.অমলেন্দু ভট্টাচার্য , বিশিষ্ট অথিতি বাংলাদেশের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড.শরদিন্দু ভট্টাচার্য সঙ্গে ছিলেন প্রাক্তন বিধায়ক ড,সুখেন্দু শেখর দত্ত,এ এস টি সি র চেয়ারম্যান মিশন রঞ্জন দাস, পুরপতি রবীন্দ্র দেব ,বঙ্গসাহিত্য কেন্দ্রীয় কমিটির সহ সভাপতি সুবীর রায় চৌধুরী,প্রাক্তন সাধারণ সম্পাদক ড, সব্যসাচী রায়, করিমগঞ্জ শহর সমিতির সভাপতি সৌমিত্র পাল,প্রমূখ ।
ড.অমলেন্দু ভট্টাচার্য তাঁর মূল্যবান বক্তব্যে লোক সংস্কৃতির বিভিন্ন দিক তুলে ধরেন। বলেন, একটি অঞ্চলের মানুষের মানসিকতা এবং জীবনধারণের পদ্ধতি যদি জানতে হয় তবে সেই অঞ্চলের লোক সংস্কৃতি জানা প্রয়োজন । লোক সংস্কৃতির ক্ষেত্রে ভূগোলের এক বিশেষ ভূমিকা রয়েছে । লোক গান কেবল মাত্র গান নয় এর সঙ্গে রয়েছে এক জীবন দর্শন । উদাহরণ স্বরূপ তিনি উল্লেখ করেন যে ভাটিয়ালি গান একদিকে যেমন এ অঞ্চলের ভূগোলের পরিচয়বাহী ঠিক তেমনি জীবন দর্শনের পরিচয় বহন করছে । বহু বছর আগে থেকে লোক সংস্কৃতির উপর কাজ করেছেন অনেক মহান ব্যক্তিরা কেননা তাঁরা জানতেন একটা অঞ্চলের মানুষের মানসিকতা জানতে হলে একমাত্র উপাদান এই লোক সংস্কৃতি । তিনি উল্লেখ করেন করিমগঞ্জ জেলার ধর্ম শাসন, ব্রাহ্মণ শাসন ও মহিশাসন এলাকার নাম । বলেন, ইতিহাসবিদ দীনেশ চন্দ্র সরকারের মতে জায়গার নামের শেষে শাসন শব্দ থাকলে বুঝতে হবে এই অঞ্চল গুলিতে কোনো সময়ে তাম্র শাসনের মাধ্যমে জনবসতি স্থাপন হয়েছিল । অর্থাৎ এর থেকে বাঙালির প্রাচীনতম ঐতিহ্য সহজেই খুঁজে পাওয়া সম্ভব । নিজেদের আত্মপরিচিতির প্রয়োজনে এবং ইতিহাসের প্রয়োজনে লোকসংস্কৃতি চর্চা অবশ্যই চালিয়ে যেতে হবে বলে তিনি মন্তব্য করেন । তিনি বলেন বাঙালির সংস্কৃতি বিগত দিনে কৃষি জীবনের মূল্যবোধের প্রেক্ষাপটে তৈরি হয়েছিল। কেননা বাঙালির সব অনুষ্ঠানের পেছনে ক্রিয়াশীল কৃষি । কিন্তু আজকের দিনে আমাদের সমাজ জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করছে বিজ্ঞান প্রযুক্তি এবং বিজ্ঞাপন । আজকের প্রজন্মের মূল্যবোধ গড়ে উঠছে ইন্টারনেটের মাধ্যমে । ফলে ক্রমশ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছি আমরা । কিন্তু এখনো এই অঞ্চলের মানুষরা নিজেদের প্রাচীন রূপকে আঁকড়ে ধরে লোকসংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করছে যা আমাদের প্রাচীনত্বের প্রতীক । তাই লোক সংস্কৃতির অঙ্গন সর্বদা আরো বিকশিত করার ক্ষেত্রে চেষ্টা করতে হবে সবাইকে। কেননা লোক সংস্কৃতি চিরকাল এক মানবিক উদারতার বার্তা বহন করে ।
অন্যদিকে বঙ্গ সাহিত্যের কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক গৌতম প্রসাদ দত্ত তাঁর বক্তব্যে বলেন, আজকের দিনে আমাদের জীবনের সব কিছু ঠিক করে দেয় বিজ্ঞাপন । আমাদের চলাফেরা, খাওয়া দাওয়া, চলন ধরন সব আজকাল বিজ্ঞাপন ঠিক করে । ফলে আজকের বাঙালিরা অনুকরণের পথে । নিজেদের জীবন যাপনের সব কিছু অনুকরণ করতে করতে নিজেদের সংস্কৃতি ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে । একদিকে ভাষিক আগ্রাসনের মাধ্যমে বাঙালিদের শেকড় উপড়ে ফেলার চেষ্টা চলছে, অন্যদিকে নাগরিকত্ব সংস্কৃতি এমন এক অবস্থানে রয়েছে যে উত্তর প্রজন্ম সম্মান সহ বাস করতে পারবে কিনা সেটা আজ বড় প্রশ্ন । তাই লোক সংস্কৃতির যোদ্ধা দের মনোবল এভাবে লোক উৎসবের মধ্যমে ছড়িয়ে দেবে যে নিজেদের সংস্কৃতি ও ভাষা কে বাঁচিয়ে রাখতে চেষ্টা চলবে ।
রাষ্ট্রীয় বিভাজনের জন্য আজ সিলেট এবং বরাক উপত্যকা পৃথক। কিন্তু দুটি স্থানের ভাষা কিন্তু এক। আর বিশেষ বৈশিষ্ট্য হল দুটি স্থানেই সিলেটি ভাষা প্রচলিত। বাঙালির সংস্কৃতি নিয়ে বক্তব্যের শুরুতে এই আবেগ তাড়িত কথা বলেন আমন্ত্রিত অতিথি বাংলাদেশের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. শরদিন্দু ভট্টাচার্য। লঙ্গাইঘাটে বরাক উপত্যকা বঙ্গ সাহিত্য ও সংস্কৃতি সম্মেলনের মাইজগ্রাম- লঙ্গাই- কর্ণমধু আঞ্চলিক কমিটির উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে তিনি বলেন বাঙালির ঐতিহ্য, সংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রাখা জরুরি। আধুনিকতার ছোঁয়ায় বাঙালির কৃষ্টি, সংস্কৃতির জলাঞ্জলী দেওয়া চলবে না। আলোচনাক্রমে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চল এবং কলকাতার প্রসঙ্গ টেনে আনেন। ভাটিয়ালি গান থেকে ওঝা গানের প্রসঙ্গ তুলে ধরেন। এবং বলেন একতারা, দুতারা এবং ডোলকে কোনভাবেই ভুললে চলবে না। কারণ এই সকল বাদ্য যন্ত্রের মধ্যে রয়েছে বাঙালির সংস্কৃতি জড়িত। অধ্যাপক শরদিন্দু ভট্টাচার্য বলেন ক্রিকেট খেলার সব সংস্করণে আমরা জড়িত হব। কিন্তু ষোলগুটি, দাড়া গুটিকে মোটেও ভুলে নয়। এবং এই সব খেলা তার কর্মক্ষেত্রের বাংলা বিভাগে করার কথাও জানান।
বঙ্গসাহিত্যের লঙ্গাই- মাইজগ্রাম- কর্ণমধু আঞ্চলিক সমিতির সভাপতি বিষান দাসের পৌরহিত্য সভার শুরুতে দুই দিবসিও লোক উৎসবের তাৎপর্য নিয়ে প্রসঙ্গিক আলোচনা করেন সম্পাদক বিভাস চন্ড দাস । আলোচনা সভায় বিধায়ক কমলাক্ষ দে পূরকায়স্থ
প্রাক্তন বিধায়ক মিশন রঞ্জন দাস, ড,সুখেন্দু শেখর দত্ত , ড, সব্যসাচী রায়,সৌমিত্র পাল প্রমূখ লোক সংস্কৃতির বিভিন্ন দিক নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেন ।