মুদ্রানীতি, মূল্যস্ফীতি ও মুদ্রাবাজারের অস্থিরতা
ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ
প্রকাশিত হয়েছে : ০৩ সেপ্টেম্বর ২০২২, ৯:২৭ মিনিটকভিড মহামারি ও ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্ব অর্থনীতিকে যে ধকল সইতে হচ্ছে, তা এড়ানোর সুযোগ বাংলাদেশের নেই। শুধু বাংলাদেশ নয়, বিশ্বের সব দেশকেই কমবেশি এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হচ্ছে। আমাদের চিন্তাগ্রস্ত করে, যখন এর সঙ্গে আমাদের নিজস্ব কিছু চ্যালেঞ্জ যুক্ত হয়। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে দেশের সার্বিক আর্থিক খাত ও বৈদেশিক মুদ্রাবাজারে অস্থিরতার সৃষ্টি হয়েছে।
তা সামাল দিতে সরকার সচেষ্ট, তবে কিছু বিষয়ে বিশেষ নজর দেওয়ারও প্রয়োজন রয়েছে। বলা প্রয়োজন, মূলত আর্থিক খাত ও মুদ্রাবাজারে অস্থিরতা দূর করার দায়িত্ব বাংলাদেশ ব্যাংকের। একই সঙ্গে এটিও মনে রাখতে হবে, এখন যে চ্যালেঞ্জগুলো রয়েছে, তা মোকাবেলা করা কেন্দ্রীয় ব্যাংকটির একার পক্ষে সম্ভব নয়।
আমাদের চ্যালেঞ্জগুলোর মধ্যে প্রথমেই রয়েছে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ। তারপর বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ঠিক রাখা এবং বৈদেশিক মুদ্রার বাজারের অস্থিরতা দূর করা। এর সঙ্গে রয়েছে রপ্তানি ও রেমিট্যান্স বাড়ানোর চ্যালেঞ্জ। এই বিষয়গুলো শুধু বাংলাদেশ ব্যাংকের নয়, সরকারের অন্য অনেক প্রতিষ্ঠান নীতি ও পদক্ষেপের সঙ্গে জড়িত। তাই বাংলাদেশ ব্যাংকের মুদ্রানীতি এবং এর সার্বিক নীতিমালা ও প্রুডেনশিয়াল নর্মস দিয়ে সমস্যাগুলোর সমাধান করা সম্ভব নয়। এ জন্য দরকার হলো একটি সমন্বিত পদক্ষেপ এবং সেটি দ্রুত গ্রহণ করতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের পাশাপাশি অর্থ মন্ত্রণালয় ও সরকারের অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব রয়েছে। সবচেয়ে বড় কথা হলো, যেকোনো নীতি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রেই, বিশেষ করে মনিটারি ট্রান্সমিশন মেকানিজমটি (পণ্যমূল্য ও অথনৈতিক কর্মকাণ্ডে মুদ্রানীতির প্রভাব প্রক্রিয়া) সংশ্লিষ্টদের ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের কর্মদক্ষতার ওপর নির্ভর করে। এ ক্ষেত্রেও সামষ্টিক অর্থনীতির স্তর থেকে শুরু করে মধ্য স্তরে যারা আছে, যেমন—বাজার, ব্যাংক, নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা, উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা হিসেবে বিডা ও রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো এবং সব শেষে স্থানীয় প্রশাসনের ভূমিকা রয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সমন্বয় তৈরি না হলে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া কঠিন।
এ অবস্থায় আমাদের বিদ্যমান মুদ্রানীতি এবং এটার প্রাসঙ্গিকতা বিবেচনা করা দরকার। প্রথমেই আমি বলব, এখানে মুদ্রানীতির সঙ্গে রাজস্বনীতির একটি গভীর সংযোগ তৈরি করতে হবে। রাজস্বনীতিতে বাজেট ঘাটতি হয়, কোনো ক্ষেত্রে বরাদ্দ কমে যায়, কোথাও প্রণোদনা দিতে হয়। ফলে এটাকে মুদ্রানীতির সঙ্গে সংগতিপূর্ণ হতে হবে। আবার মুদ্রানীতি যদি মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করতে চায়, তাহলে এর মাধ্যমে বাজারে অর্থের সরবরাহ কমাতে সার্বিক চাহিদা নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা করতে হয়। কিন্তু এর বিপরীতে যদি বড় বড় প্রকল্প দাঁড় করানো হয়, সরকারিভাবে বড় আকারের আমদানি অব্যাহত থাকে এবং সরকারি খাতে বড় আকারে বৈদেশিক মুদ্রার লেনদেন হয়, তাহলে তা মুদ্রানীতির জন্য বিপরীতমুখী পদক্ষেপ হিসেবে গণ্য হয়।
এই মুহূর্তে আমাদের মূল্যস্ফীতি ও বৈদেশিক মুদ্রার চ্যালেঞ্জ সঠিকভাবে মোকাবেলা করতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংক এ চেষ্টা করছে। তবে এ ক্ষেত্রে তাদের স্বাধীনতা যেটুকু আছে, সেটা হলো ব্যাংকিং খাতের ওপর নিয়ন্ত্রণ। এটি সামগ্রিক প্রক্রিয়ার একটি অংশ হলেও ছোট করে দেখার বিষয় নয়। ব্যাংক খাতে নানা রকম অনিয়ম রয়েছে। এখানে দক্ষতা, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির অভাব রয়েছে। ইদানীং একটি ভালো জিনিস লক্ষ করা যাচ্ছে, ব্যাংকিং সেক্টরে সুশাসন ফিরিয়ে আনা এবং মনিটরিং জোরদার করার ব্যাপারে বাংলাদেশ ব্যাংক তৎপর। তবে প্রক্রিয়াটি নিয়ে প্রশ্নও আছে। বাংলাদেশ ব্যাংক ১০টি ব্যাংকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এ ছাড়া ছয়টি ব্যাংকের এমডির কাছে ব্যাখ্যা চাওয়া হয়েছে, কয়েকটি ব্যাংকের ফান্ড ম্যানেজারকে প্রত্যাহার করার উদ্যোগ দেখা গেছে। সমস্যা হচ্ছে, এভাবে বিচ্ছিন্নভাবে কিছু করলে সার্বিক অবস্থার উন্নতি হয় না। কারণ ওই ব্যাংকগুলো ছাড়াও অন্য অনেক ব্যাংকেই একই ধরনের অনিয়ম রয়েছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে অনিয়ম আরো বেশি আছে।
এ অবস্থায় সার্বিকভাবে আমি গুরুত্ব দিতে চাই প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের ওপর, যাতে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে কাঠামোগতভাবে শক্তিশালী করা যায়। সংস্কার বলতে আমি আইনগতভাবে ব্যাপক পরিবর্তনের কথা বলছি না। তবে আইনের ক্ষেত্রে কিছু ধারা অবশ্যই পরিবর্তন করতে হবে। যেমন—ব্যাংকের পরিচালনায় একই পরিবারের পাঁচজন সদস্য থাকতে পারেন এবং তাঁরা চাইলে ৯ বছর পর্যন্ত থাকতে পারবেন। এ ছাড়া ঋণের প্রভিশনিং ও পুনঃ তফসিলীকরণ করার মতো কিছু নীতি রয়েছে। এগুলোতে হাত দিতে হবে। কারণ এগুলো উল্টো ফল দিচ্ছে। ব্যাংকে অনেক আগে থেকেই, বিশেষ করে আশির দশক থেকে শুরু করে নব্বইয়ের দশকে বারবার সংস্কার ও পরিবর্তন আনা হয়েছে, নীতিতে পরিবর্তন আনা হয়েছে। এগুলো মোটামুটি ঠিক ছিল। এর পরও কিছু ব্যাংক সমস্যার মধ্য দিয়েই গেছে। এখন বহু ব্যাংকেই সমস্যা ছড়িয়ে পড়েছে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের বিশেষ তৎপরতার প্রয়োজন।
এই কথাগুলো আসছে এই কারণে যে আমাদের বর্তমানের বড় সমস্যা হচ্ছে মূল্যস্ফীতি এবং তা নিয়ন্ত্রণে সবাইকেই তৎপর হতে হবে। মূল্যস্ফীতি অনেকটাই সরবরাহজনিত বিষয়। আর আমাদের সরবরাহ চেইনের বড় উৎস আমদানি। বাইরে কোনো পরিস্থিতিতে পণ্যমূল্য বেড়ে গেলে কিংবা সরবরাহে বিঘ্ন ঘটলে আমাদের এখানে বেশ বড় প্রভাব পড়ে। আবার আমাদের অভ্যন্তরীণ কিছু দুর্বলতা ও অনিয়মের কারণে প্রভাবটা কয়েক গুণ বেড়ে যায়। বাইরে জ্বালানি তেলের দাম বেড়ে গেলে জাহাজে পরিবহন ব্যয়সহ নানা কারণে আমদানি ব্যয় বেড়ে যায়। এটাকে আমরা বলি ইমপোর্টেট ইনফ্লেশন। এর প্রতিফলন বাজারে পড়ে। এরপর দেশের ভেতরে বড় বড় শিল্পগোষ্ঠী, ব্যবসায়ী গোষ্ঠী এবং বড় বড় আড়তদার ও পরিবেশকরা কিভাবে বাজারে প্রভাব বিস্তার করে, সেদিকেও নজর দিতে হবে। এদিকটায় বরাবরই নজর কম দেওয়া হয়। সম্প্রতি ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরকে অভিযান চালাতে দেখছি। কিন্তু এগুলো সাময়িক ও আংশিক পদক্ষেপ। বিচ্ছিন্ন অভিযান না চালিয়ে বড় ধরনের জরিমানা কিংবা সাময়িক বা স্থায়ীভাবে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করার ব্যবস্থা করতে পারলে কিছু কাজ দিতে পারে।
মূল্যস্ফীতির ক্ষেত্রে আমাদের চালের দামের দিকে সবচেয়ে বেশি নজর দিতে হবে। এটাকে নিয়ন্ত্রণে রাখতেই হবে। চাল আমাদের ভোগের প্রধান অংশ। তাই চালের মূল্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এটা নিয়ন্ত্রণ করতে হলে প্রথমেই নজর দিতে হবে কৃষিতে। এ খাতে উৎপাদন বৃদ্ধি, প্রযুক্তির উন্নয়ন ও সহজলভ্যতা এবং সর্বোপরি প্রণোদনার ব্যবস্থা করতে হবে। এ খাতে আগের চেয়ে প্রণোদনা কমেছে। এটাকে আরো বাড়াতে হবে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের ভূমিকাও রয়েছে।
এখন আসা যাক বৈদেশিক মুদ্রা প্রসঙ্গে। এই মুহূর্তে আমাদের রিজার্ভ মুদ্রা ডলারের দাম বিভিন্ন স্তরে বিভিন্ন রকম দেখা যায়। সরকারিভাবে প্রতি ডলারের দাম ৯৫ টাকা। আবার ব্যাংকাররা বাজার থেকে অর্থাৎ এক্সচেঞ্জ হাউসগুলো থেকে নির্ধারিত হারের চেয়ে ১০৫ বা ১০৬ টাকা দিয়ে ডলার ক্রয় করছে। কারণ প্রবাসীরা কম দামে ডলার পাঠাতে চান না। তাই তাঁরা হুন্ডির দিকে ঝুঁকছেন। অন্যদিকে ব্যাংকগুলো যখন রপ্তানি নগদায়ন করে, তখন তাদের ১০২ বা ১০৩ টাকা প্রদান করতে হচ্ছে। আর কার্ব মার্কেটে ডলার ১১০-১১২ টাকায় বিক্রি হচ্ছে, যা একসময় ১২০ টাকা পর্যন্ত উঠেছিল। প্রশ্ন হচ্ছে, এগুলো নিয়ন্ত্রণ করা যায় কিভাবে? নীতিনির্ধারকরা বলছেন, আগামী দুই-তিন মাসের মধ্যে পরিস্থিতি ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু বর্তমান নীতিতে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করা কঠিন হবে। তাই নীতিগুলোকে আরো যৌক্তিক করতে হবে।
এই অবস্থায় বৈদেশিক মুদ্রা আহরণ বৃদ্ধির বিষয়ে বিশেষ জোর দিতে হবে। এর মধ্যে তৈরি পোশাক রপ্তানি বাড়ানোর চেষ্টা আছে। কিন্তু আদৌ এতে কতটা সাফল্য পাওয়া যাবে তা-ও ভাবতে হবে। তাই সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) ও পোর্টফোলিও বিনিয়োগ কিভাবে বাড়ানো যায় সে জায়গায় কাজ করতে হবে। এ বিষয়টি বাংলাদেশ ব্যাংকের একার দায়িত্ব নয়। এখানে সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন ও রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর বিশেষ দায়িত্ব রয়েছে।
মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ ও মুদ্রাবাজারের অস্থিরতা দূর করতে হলে এই মুহূর্তে বাংলাদেশ ব্যাংককে সদা তৎপর থাকতে হবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের যতটুকু করণীয় তা করতে হবে। এ জন্য নীতি পর্যালোচনার দরকার আছে। যেমন—কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাজারে মুদ্রা সরবরাহ কমিয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। কিন্তু রেপো রেট বাড়িয়ে মুদ্রা সংকোচন করার বিপরীতে সুদের হার ছেড়ে না দেওয়া পরস্পরবিরোধী অবস্থান। তাই বাংলাদেশ ব্যাংককে তার নীতি পর্যালোচনা করতে হবে। তবে শেষ কথা হলো, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ ও মুদ্রাবাজারের অস্থিরতা দূর করতে সমন্বিত পদক্ষেপ লাগবে।
লেখক : সাবেক গভর্নর, বাংলাদেশ ব্যাংক এবং অধ্যাপক, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়