১৫ আগস্ট ১৯৭৫: যতটুকু মনে পড়ে
খালেদ জাফরী
প্রকাশিত হয়েছে : ১৫ আগস্ট ২০২২, ১২:২৫ মিনিট
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ইতিহাসের নৃশংসতম ঘটনার মাধ্যমে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করা হয় সপরিবারে। এ দিনটিকে ঘিরে আমার কিছু স্মৃতি রয়েছে। বঙ্গবন্ধুর ৪৭তম শাহাদাত বার্ষিকীতে এ স্মৃতিটুকু তুলে ধরলাম।
আমি তখন ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ি। আমার পিতা মরহুম আকাদ্দস সিরাজুল ইসলাম ছিলেন বিয়ানীবাজার থানা (অধুনা উপজেলা) আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। তাই বাড়িতে মানুষের ভিড় লেগেই থাকতো। বাইরের মানুষ ফটিকে( বসারঘর) বসতেন। নানা বিষয়ে আলাপ হতো। এর মধ্যে রাজনীতিই ছিল মুখ্য। আগত লোকজনকে চা-পান তথা নাস্তা নিয়ে দিতাম আমি। মুরব্বিদের আলাপচারিতা থেকে টুকরো টুকরো কানে কথা ভেসে আসতো। সে সময়ে যতটুকু বুঝেছি এবং পরবর্তীতে জেনেছি, বঙ্গবন্ধুর সাথে বিয়ানীবাজারের মানুষের এক হার্দিক সম্পর্ক ছিল। বিয়ানীবাজার থানা আওয়ামী লীগের প্রাণপুরুষ এম এ আজিজ ছিলেন বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহচর। ১৯৪৭ সালে ভারতবিভক্তির আগে এম এ আজিজের পরিবার ভারতের করিমগঞ্জে বসবাস করতেন। সেখানে তাদের পৈতৃক ব্যাবসা ছিল। সেখানেই বঙ্গবন্ধুর সাথে তাঁর পরিচয়। বঙ্গবন্ধু দুবার বিয়ানীবাজার আসেন। ১৯৪৭ সালে সিলেটে গণভোট অনুষ্ঠিত হয়। সিলেট জেলা পাকিস্থান নাকি ভারতে যাবে এ নিয়ে ছিল গণভোট। মুসলিম লীগ ছিল পাকিস্থানের পক্ষে। অন্যদিকে ছিল কংগ্রেস । গণভোটকে কেন্দ্র করে প্রচারণা চালাতে ১৯৪৭ সালে বঙ্গবন্ধু প্রথমবার বিয়ানীবাজার এসেছিলেন। আর শেষবার এসেছিলেন ৬ দফা আন্দোলনের সময় ১৯৬৬ সালে। সেবার তিনি এম এ আজিজের বাড়িতে রাতযাপন করেন। সেখানে সিলেটেরে ঐতিহ্যবাহী বাশেঁর করুল এবং হাঁসের মাংস দিয়ে তাঁকে আপ্যায়িত করা হয়। এম এ আজিজকে বঙ্গবন্ধু ডাকতেন ‘ আজিজ বিয়ানীবাজারী’ বলে।
থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাহিত্যিক সাংবাদিক আকাদ্দস সিরাজুল ইসলামের পরিবার কোলকাতায় বসবাস করতেন। তাঁর পড়াশোনা এবং বেড়ে ওঠা কোলকাতায়। বঙ্গবন্ধু যখন কোলকাতা ইসলামিয়া কলেজের ছাত্র, তখন আকাদ্দস সিরাজুল ইসলাম রিপন কলেজে পড়তেন। তাঁদের মধ্যে পরিচয় ছিল। কুখ্যাত হলওয়ে মনুমেন্ট আন্দোলন তাঁরা একসাথে করেছেন।
১৯৭৫ সালের ১৩ জুন বিয়ানীবাজার থানা আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ শেষবারের মত বঙ্গবন্ধুর সাথে দেখা করেন। সে সময় বঙ্গবন্ধু বিয়ানীবাজার আসার আগ্রহ প্রকাশ করেন। শীতেরদিনে তিনি আসবেন এ রকমই কথা হয়। কিন্তু তা আর হল না। বঙ্গবন্ধুর কর্মসূচির দিনক্ষণ ঠিক করার জন্য এ আগস্টেই থানা আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দের ঢাকা যাওয়ার কথা ছিল।
আমাদের বাড়ির পাশেই নানা বাড়ি। অবশ্য ভিন্ন মহল্লা। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সকালে নানাকে নিয়ে আসতে নানা বাড়ি যাই। তাঁকে সাথে নিয়ে আসি। নানার সাথে আব্বা ও আম্মা কথা বলেন। আলাপ শেষে নানা বাড়ি চলে যান।একটু পর তিনি আবার আমাদের বাড়িতে ফিরে আসেন। আম্মার সাথে কি যেন আলাপ করেন। মা আর্তনাদ করে ওঠেন। দ্রুত আব্বার ঘরে গিয়ে বলেন,
:বঙ্গবন্ধুরে বুঝি মারিলাইছে?
আব্বা বিছানায় শোয়া ছিলেন। ওঠে বসলেন। ধমক দিয়ে বললেন, : ধেৎ। কি আবোল তাবোল বকছো।
মা বললেন: আবোল তাবোল নায়। রেডিওত কইছে।
: রেডিওত কইছে? কে বলছে?
আম্মা বললেন, আব্বা হুনিয়া আইছইন।
নানা আব্বার ঘরে আসলেন। নানা বললেন, আমাদের বাড়ি থেকে ফেরার পথে একজন প্রতিবেশি এ কথা তাকে বলেছেন। তিনি নাকি রেডিওতে শুনেছেন।
আমরা সবাই বাকরুদ্ধ। আমাদের রেডিও ছিলনা। আমাকে পাঠানো হল সেই প্রতিবেশিকে ডেকে আনতে। তিনি রেডিও সাথে নিয়ে চলে এলেন। সবাই রেডিও ঘিরে দাঁড়াল।কিন্তু না, রেডিও কিছু বলছে না। একটানা মিউজিক বেজেই চলেছ। সে এক বিরক্তিকর অপেক্ষা। হঠাৎ শোনা গেল একটি জরুরি ঘোষণা… আমি মেজর ডালিম বলছি, স্বৈরাচারি মুজিব সরকারকে উৎখাত করা হয়েছে। খন্দকার মুশতাক আহমদ রাষ্ট্রপতির দায়িত্বগ্রহন করেছেন। কিছুক্ষণের মধ্যে তিনি জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দেবেন। সারা দেশে সান্ধ্য আইন জারি করা হয়েছে। … আবার সিগনেচার টিউল বাজতে থাকলো।
এ ঘোষণা শুনে সবাই যেন পাথর হয়ে গেলেন। হঠাৎ কে একজন বললেন, সাড়ে নটায় আকাশবাণী কোলকাতা থেকে বাংলা খবর দেবে। অনেক কসরত করে আকাশবাণী কোলকাতা কেন্দ্র ধরা হল। এ কেন্দ্র থেকে প্রচারিত সংবাদে জানা গেল,সেনা অভ্যুত্থানে বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিহত হয়েছেন। সামরিক বাহিনী রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেছে। খন্দকার মুশতাক আহমদ নতুন রাষ্ট্রপতি নিযুক্ত হয়েছেন।বহিঃবিশ্বের সাথে বাংলাদেশের টেলিযোগাযোগ বন্ধ রয়েছে। রেডিও এবং টেলিভিশন কেন্দ্র সেনাবাহিনী দখল করেছে। ঢাকার রাস্তায় সেনাবাহিনী টহল দিচ্ছে…
বেলা গড়িয়ে যাচ্ছে। প্রথমে আসলেন থানা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক আব্দুস শাকুর। আব্বার গলা জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়লেন। এরপর একে একে আসলেন এম এ আজিজ, ফৈজুর রহমান ফৈয়াজসহ আরো অনেকে। যেন কান্নার রোল পড়ে গেলো। কান্নাকাটি একসময় থামল। নানামুখী আলাপ আলোচনা হল। খন্দকার মুশতাকের ভাষণ শুনলেন সবাই। ভাষণে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের ‘সূর্যসন্তান’ বলে উল্লেখ করা হল। ভাষণ শেষ হল ‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’ ধ্বনি দিয়ে। উপস্থিত সবাই খন্দকার মুশতাককে বিশ্বাসঘাতক বলে আখ্যায়িত করলেন।
এতকিছুর পরও কেউ কেউ ভিন্ন কিছু আশা করেছিলেন। কিন্তু গুঁড়ে বালি। একে একে সেনা,নৌ, বিমান, বিডিআর, পুলিশ এবং রক্ষীবাহিনী প্রধানগণ মুশতাকের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করায় সবাই যেন একেবারে ভেঙে পড়লেন।
সন্ধ্যায় মুশতাকের মন্ত্রীসভা গঠিত হল। বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রীদের মধ্যে হাতে গোনা মাত্র কয়েকজন ছাড়া প্রায় সকলেই মুশতাকের মন্ত্রীসভায় অন্তর্ভুক্ত হলেন। বিশ্ববাসী বাঙালির বিশ্বাসঘাতকতার নতুন নমুনা দেখল! বঙ্গবন্ধুর লাশ তখনো ধানমণ্ডির ৩২ নম্বরের সিঁড়িতে পড়ে আছে অযত্নে।
সন্ধ্যায় বিবিসি এবং রাতে ভয়েস অব আমেরিকার সংবাদ শুনলাম সবাই মিলে। না, আশা উদ্রেক করার মত নতুন আর কোন সংবাদ পাওয়া গেল না।
১২ ডিসেম্বর ১৯৭৫ সন্ধ্যা। সে সময়ের ছাত্রনেতা আজিজুর রহমান সাবু আমাদের বাড়িতে আসলেন। আব্বাকে থানায় নিয়ে যাবেন। সেখানে নাকি আসন্ন ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসের কর্মসূচি নিয়ে আলোচনা হবে। এম এ আজিজকে আনার জন্য তাঁর ভাতিজা থানা ছাত্রলীগের সভাপতি সাইদ আহমদ হেলালকে পাঠান হয়েছে। থানা আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষ ফৈজুর রহমান ফৈয়াজকে আনতেও লোক গেছে। আব্বা ছিলেন অসুস্থ । তিনি আর যেতে পারেননি। আজিজুর রহমান সাবু কিছুক্ষণ গম্ভীর হয়ে বসে রইলেন। চলে যাবার আগে বললেন, বুঝতে পারছিনে কী হতে যাচ্ছে! তাঁকে চিন্তিত মনে হল। আমরাও আতংকিত হয়ে পড়লাম। পরিবারের বড়রা আব্বাকে পাশের বাড়িতে নিয়ে যাবার জন্য চেষ্টা করলেন। কিন্তু তিনি রাজি হলেন না।
রাত সাড়ে ১২টার দিকে সদলবলে আসলেন বিয়ানীবাজার থানার তৎকালীন থার্ড অফিসার মি. পাটোয়ারী। আব্বাকে ডেকে ঘুম থেকে তোলা হল। কি যেন আলোচনা হল। মি. পাটোয়ারি বললেন সবাই থানায় এসে আব্বার জন্য নাকি অপেক্ষায় আছেন। আব্বাকে শীতের কাপড় সাথে নেওয়ার জন্য বারবার তাগিদ দিলেন। আব্বা শীতের কাপড় আনতে পাশের কক্ষে গেলে একজন পুলিশ সদস্য দেয়ালে ঝুলানো বঙ্গবন্ধুর ছবির দিকে ইঙ্গিত করে বললেন এখনো বঙ্গবন্ধুর ছবি টাঙ্গানো আছে! পুলিশ অফিসার তাকে ধমক দিলেন।
আব্বাকে নিয়ে ঘর থেকে বের হবার পর দেখা গেল আমাদের বাড়ি ঘিরে ছিল পুলিশের অনেক সদস্য। একে একে সবাই এসে উঠানে দাঁড়ালো। তাদের সংখ্যা বিশের কম নয়!
সকালবেলা পরিবারের লোকজন থানায় গেলেন খোঁজ নিতে। সেখানে গিয়ে জানতে পারলেন ভোরে আওয়ামী লীগের সভাপতি এম এ আজিজ, সাধারণ সম্পাদক আকাদ্দস সিরাজুল ইসলাম, কোষাধ্যক্ষ ফৈজুর রহমান ফৈয়াজ , ছাত্রনেতা আজিজুর রহমান সাবু, সাইদ আহমদ হেলাল এবং আব্দুস শাকুর এ ৬জনকে বিশেষ ক্ষমতা আইনে গ্রেফতার দেখিয়ে কারাগারে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে।
** তথ্যসূত্র: আকাদ্দস সিরাজুল ইসলামে লেখা ‘বন্দিজীবনের কিছুকথা’ এবং ‘কারাগার থেকে বেরিয়ে।’