কানাইঘাটের নাজিম হত্যার নেপথ্যে….
স্টাফ রিপোর্টার :
প্রকাশিত হয়েছে : ১৯ জুলাই ২০২২, ১২:৪৪ মিনিট‘আমার স্ত্রীকে পতিতা হিসেবে চায় নাজিম। এজন্য বার বার চাপ দিচ্ছিলো। শেষে ক্ষুব্ধ হয়ে মুগুর দিয়ে মাথায় এলোপাতাড়ি আঘাত করে নাজিমকে খুন করি। এরপর লাশ নদীর তীরে ফেলে চলে আসি’- গ্রেপ্তারের পর পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে এ কথা জানায়, রুহেল আহমদ। হত্যার ঘটনাটি স্বীকার করার কারণে গতকাল বিকালে রুহেলকে সিলেটের আদালতে হাজির করে পুলিশ। আদালতেও স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে এ তথ্য জানায় রুহেল। এরপর রুহেলকে আদালতের নির্দেশে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। ঘটনাটি সিলেটের কানাইঘাটের নিজ রাজাগঞ্জের আলোচিত একটি হত্যাকাণ্ড। তবে- আসামি ছিল অজ্ঞাত। ৫ দিনের অনুসন্ধান শেষে গতকাল ভোররাতে ঘাতক রুহেলকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
আর প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদেই রুহেল খুনের ঘটনা স্বীকার করেছে। একই গ্রামের বাসিন্দা রুহেল আহমদ। এলাকার পরিচিত জনদের সে প্রায় সময় পতিতা সরবরাহ করতো। সিলেট শহর সহ বিভিন্ন এলাকা থেকে সে পতিতা নিয়ে অসামাজিক কর্মকাণ্ডের ব্যবসা করতো। এ কারণে বাজারের ব্যবসায়ী নাজিমের সঙ্গেও সম্পর্ক ছিল রুহেলের। আগে সে নাজিমের কাছে পতিতা সরবরাহ করতো। ঈদের সময় নিজ রাজাগঞ্জ গ্রামের মনির উদ্দিনের পুত্র নাজিম উদ্দিন এলাকার বাসিন্দা রুহেল আহমদের কাছে পতিতা নিয়ে আসার আবদার করে। কিন্তু রুহেল নাজিমের সেই আবদার পূরণ করতে পারছিল না।
এক পর্যায়ে রুহেলের কাছে তার স্ত্রীকে দেয়ার প্রস্তাব করে নাজিম। এতে ক্ষুব্ধ হয় রুহেল। তবে এ ব্যাপারে রুহেল সরাসরি কোনো প্রতিক্রিয়া দেখায়নি। খুনের ঘটনাটি ঘটে গত ১৩ই জুলাই রাত ৯টার দিকে। ওই দিন নাজিম রুহেলকে ফোন করে তার স্ত্রীকে নদীর ধারে নিয়ে আসতে বলে। কথামতো রুহেল একা সেখানে যায়। নাজিম ও রুহেল এক সঙ্গে সিগারেটও পান করে। এক পর্যায়ে নাজিম রুহেলের কাছে জানতে চায়; স্ত্রীকে কেন নিয়ে আসেনি। এতে ক্ষুব্ধ হয় রুহেল। আগে থেকে সঙ্গে রাখা মুগুর দিয়ে নাজিমের মাথায় উপর্যুপরি আঘাত করে। এতে নাজিম মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। এক পর্যায়ে রুহেল নাজিমের মোবাইল ফোন ও পকেটে থাকা টাকা পয়সা নিয়ে চলে আসে। এদিকে- নাজিমের লাশ রাতভর সুরমা নদীর তীরে ছিল। সকালে স্থানীয় লোকজন দেখে পুলিশকে খবর দেয়। পরে কানাইঘাট থানা পুলিশ লাশ উদ্ধার করে নিয়ে আসে। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা কানাইঘাট থানার এসআই দেবাশীষ শর্মা জানিয়েছেন- নাজিমের লাশের মাথা ছিল ছিন্নভিন্ন। এ কারণে প্রথমেই অনুমান করা হয় তাকে কেউ হত্যা করেছে। কিন্তু কে হত্যা করেছে সেটি ছিল অজ্ঞাত।
লাশ উদ্ধারের পর থানায় মামলা দায়ের করা হয়। খুনের ঘটনাটি নিয়ে এলাকায় চাঞ্চল্য দেখা দেয়। এদিকে- এ ঘটনার পর সিলেটের পুলিশ সুপার (অতিরিক্ত ডিআইজি) ফরিদ উদ্দিন আহমদ ক্লুলেস এ হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদ্ঘাটনে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ক্রাইম অ্যান্ড অপস্) শাহরিয়ার বিন সালেহ, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ডিএসবি অ্যান্ড মিডিয়া) মো. লুৎফর রহমান ও কানাইঘাট সার্কেলের সহকারী পুলিশ সুপার মো. আব্দুল করিমের সমন্বয়ে তিন সদস্যের কমিটি গঠন করে দেন। এবং তদন্ত করে প্রকৃত আসামিকে গ্রেপ্তারের নির্দেশ দেন। পরে ওই তিন কর্মকর্তার নির্দেশনার আলোকে তদন্ত কর্মকর্তা এসআই দেবাশীষ শর্মা তদন্ত শুরু করেন। তিনি জানান, তথ্য প্রযুক্তির মাধ্যমে মোবাইল ফোনে নিশানা খুঁজে পেলেও খুনি নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছিলো না। তদন্তের এক পর্যায়ে সন্দেহভাজন কয়েকজনকে আটক করা হয়। তাদের জিজ্ঞাসাবাদের মাধ্যমে কিছু তথ্য মিলে। আর এসব তথ্য যাচাই-বাছাইয়ের মাধ্যমে বেরিয়ে আসে একই এলাকার রুহেল আহমদের নাম। এর প্রেক্ষিতে গতকাল ভোররাতে অভিযান চালিয়ে রুহেলকে গ্রেপ্তার করা হয়। তিনি জানান, রুহেলের কোনো পেশা নেই। সে এলাকায় বিভিন্নজনের কাছে পতিতা সরবরাহ করে। আর পতিতাদের কাছ থেকে ভাগ নিয়ে তার সংসার চালায়। গ্রেপ্তারের পর রুহেল স্বীকার করেছে; তার স্ত্রীকে পতিতা হিসেবে চাওয়ায় সে ক্ষুব্ধ হয়ে নাজিমকে খুন করেছে। আর খুনের পর সে ব্যবহৃত মুগুর পাশের সুরমা নদীতে ফেলে দিয়েছে।
নদীতে স্রোত ও পানিভর্তি থাকার কারণে মুগুর উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। এদিকে ঘটনা প্রসঙ্গে গতকাল সিলেট জেলা পুলিশের তরফ থেকে পাঠানো এক বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয় ‘নিহত নাজিম ও রুহেলের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। মাঝে মধ্যে তারা বাইরে থেকে নারী এনে অসামাজিক কাজ করতো। ঈদ পরবর্তী সময়ে নাজিম আসামি রুহেলকে পতিতা আনার জন্য বললে সে তা আনতে পারেনি। এক পর্যায়ে নাজিম মেয়ে সংগ্রহ করতে না পারলে তার বন্ধু রুহেলের স্ত্রীকে নিয়ে আসার জন্য বলে। এ কথা বলার পর রুহেল এশার নামাজের ঠিক পরপর নদীর পাড়ে এসে দু’জনে সিগারেট সেবনের এক পর্যায়ে নাজিম রুহেলকে তার স্ত্রীকে আনার কথা জিজ্ঞাসা করলে আগে থেকে লুকিয়ে রাখা মুগুর দিয়ে মাথায় একাধিকবার আঘাত করে। এতে নাজিমের মৃত্যু হয়। পরে আসামি রুহেল নাজিমের লোন উত্তোলনের নগদ টাকা ও একটি স্মার্ট ফোন নিয়ে যায়।’ সিলেট জেলা পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ও মিডিয়া মুখপাত্র মো. লুৎফর রহমান জানিয়েছেন, মামলা দায়েরের পরবর্তী সময়ে পুলিশ সুপারের নির্দেশনায় স্থানীয় ভাবে ও প্রযুক্তির মাধ্যমে অনুসন্ধান শুরু করে পুলিশ। এরপর নিশ্চিত হওয়ার পর রুহেলকে গ্রেপ্তার করা হয়।
আর গ্রেপ্তারের পর সে ঘটনা স্বীকার করেছে। সিলেট জেলা পুলিশের সদস্যরা অপরাধ দমন এবং অপরাধ নিবারণে সর্বোচ্চ পেশাদারিত্বের প্রমাণ রেখেছেন বলে জানান তিনি। এদিকে- ঘটনার পর নিজ বাড়িতেই ছিল আসামি রুহেল আহমদ। সে স্বাভাবিক ভাবেই চলা ফেরা করছিল। তার মধ্যে কোনো অনুশোচনাও লক্ষ্য করা যায়নি। গ্রামের লোকজন জানান, খুনের পর রুহেল বাড়িতে চলে আসে। এরপর স্বাভাবিকভাবে সে চলাফেরা করছিল। বাজারেও যাতায়াত করেছে। এ কারণে কেউ তাকে সন্দেহ করতে পারেনি। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা জানিয়েছেন, গতকাল বিকালে সিলেটের আদালতে খুনের দায় স্বীকার করে আদালতে জবানবন্দি দিয়েছে ঘাতক রুহেল। এরপর তাকে আদালতের নির্দেশে সিলেট কেন্দ্রীয় কারাগারে প্রেরণ করা হয়েছে। যেহেতু ক্লুলেস এ ঘটনার রহস্য উদ্ঘাটন এবং স্বীকারোক্তি মিলেছে এ কারণে ন্যায়বিচারের স্বার্থে দ্রুততম সময়ের মধ্যে আদালতে চার্জশিট প্রদান করা হবে।