পুতিনকে বোঝাতে ভূমিকা নিতে পারেন এরদোয়ান
সাব্বির খান
প্রকাশিত হয়েছে : ১৭ জুলাই ২০২২, ৫:৩৩ মিনিটজাতিসংঘের কূটনীতিকদের মতে, শস্যের চালানগুলো বন্দর থেকে সরিয়ে নেওয়ার সময় রাশিয়ার পক্ষ থেকে ‘যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হওয়া’ একটি সমাধান হতে পারে। যুদ্ধবিধ্বস্ত ইউক্রেন থেকে রপ্তানি বাধাগ্রস্ত হওয়ার কারণে দাম আরো কয়েক ধাপ বেড়েছে
বিশ্বজুড়ে খাদ্যসামগ্রীর মূল্যবৃদ্ধিসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে কোটি কোটি সাধারণ মানুষের নাভিশ্বাস উঠেছে। অন্যদিকে শস্যের ভাণ্ডার ইউক্রেনে লাখ লাখ টন শস্য পচে যাওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। এ কারণেই কৃষ্ণ সাগরের ওপর দিয়ে ইউক্রেনের খাদ্যশস্য রপ্তানির ক্ষেত্রে বিদ্যমান প্রতিবন্ধকতা তুলে নেওয়া অপরিহার্য হয়ে উঠেছে।
ইউক্রেনের শস্য ও পণ্যবাহী জাহাজগুলোকে মুক্তভাবে চলতে দেওয়ার ব্যাপারে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনকে রাজি করাতে তুর্কি নেতা রিসেপ তাইয়িপ এরদোয়ান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারেন বলে অনেকেরই ধারণা। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা পালন করার দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন। তিনি ইউক্রেনীয় শস্যসহ পণ্যবাহী জাহাজগুলোকে কৃষ্ণ সাগর থেকে নিরাপদে বের করে বিশ্বের বিভিন্ন গন্তব্যে পৌঁছে দিতে উভয় পক্ষকে নিয়ে আলাপ-আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছেন।
উল্লেখ্য, প্রথমে ভূমধ্যসাগর এবং তার পরে অন্যান্য মহাসাগরে পৌঁছানোর জন্য জাহাজগুলোকে তুরস্কের ‘সুইয়ের চোখ’ খ্যাত বসফরাস চ্যানেলের মধ্য দিয়ে যেতে হবে। ইউক্রেন যুদ্ধ চলাকালে তুরস্ক ইউক্রেন ও রাশিয়া উভয় পক্ষের সঙ্গেই সুসম্পর্ক বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছে। তুরস্ক ন্যাটো সদস্য হলেও পশ্চিমের অন্যান্য দেশের সঙ্গে হাত মিলিয়ে রাশিয়ার ওপর শাস্তিমূলক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা থেকে বিরত থেকেছে। এ কারণেই তুরস্ক ইউক্রেনে উৎপাদিত শস্য বিশ্বের অন্যান্য দেশে রপ্তানির সুযোগ সৃষ্টির ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। এরই মধ্যে চলতি সপ্তাহের শুরুতে তুর্কি নেতা এরদোয়ান রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ও ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভোলোদিমির জেলেনস্কির সঙ্গে কথা বলেছেন। পুতিনের সঙ্গে এরদোয়ানের আলোচনার একটি সারসংক্ষেপ তুলে ধরে তুর্কি প্রেসিডেন্টের কার্যালয়ের এক মুখপাত্র বলেছেন, প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান মনে করেন, শস্য রপ্তানির জন্য কৃষ্ণ সাগরের মধ্য দিয়ে নিরাপদ করিডর তৈরির একটি যৌক্তিক পরিকল্পনা তৈরি করতে জাতিসংঘের পদক্ষেপ নেওয়ার সময় এসেছে।
এই বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে গত মঙ্গলবার তুরস্ক, রাশিয়া, ইউক্রেন এবং জাতিসংঘের কূটনীতিকদের মধ্যে সম্ভাব্য একটি চুক্তির খসড়া তৈরির জন্য ইস্তাম্বুলে বৈঠক হয়েছে বলে জানান প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানের মুখপাত্র। গত বুধবারই তুরস্কের প্রতিরক্ষামন্ত্রী হুলুসি আকর বলেছেন, চার পক্ষের আলোচনার ফলে একটি চুক্তিতে উপনীত হওয়া সম্ভব হয়েছে। যুক্তরাজ্যের গার্ডিয়ান পত্রিকার এক প্রতিবেদনে এ কথা বলা হয়েছে। সপ্তাহখানেকের মধ্যে চার পক্ষ আবার মিলিত হলে চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
জাতিসংঘের কূটনীতিকদের মতে, শস্যের চালানগুলো বন্দর থেকে সরিয়ে নেওয়ার সময় রাশিয়ার পক্ষ থেকে ‘যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হওয়া’ একটি সমাধান হতে পারে। একই সময়ে অস্ত্র চোরাচালানের ব্যাপারে রাশিয়ার ভয় দূর করতে জাতিসংঘের সমর্থনে তুরস্ক জাহাজের কার্গো পরিদর্শন ও নজরদারি করার দায়িত্ব পালন করবে। আগামী সপ্তাহেই প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান সিরিয়ার যুদ্ধ নিয়ে আলোচনা করতে পুতিনের সঙ্গে তেহরানে দেখা করবেন। তাঁরা উভয়েই সিরিয়ার স্বৈরশাসক বাশার আল-আসাদের পাশে দাঁড়িয়েছেন। কৃষ্ণ সাগরে রাশিয়ার অবরোধ এবং ইউক্রেনের শস্য রপ্তানি তাঁদের আলোচনার এজেন্ডায় থাকবে বলে পর্যবেক্ষকরা আশা করছেন।
তুরস্ক এরই মধ্যে বেশ কয়েকবার ইউক্রেনের শস্য পুনরায় রপ্তানিতে সহায়তার প্রস্তাব দিয়েছে। তুর্কি সরকার জানিয়েছে, রপ্তানিকে ত্বরান্বিত করতে কৃষ্ণ সাগরে তাদের ২০টি জাহাজ দ্রুত ইউক্রেনীয় শস্য বোঝাই করার জন্য প্রস্তুত রাখা হয়েছে। কৃষ্ণ সাগরে ইউক্রেনীয় বন্দরগুলোতে রাশিয়ার অবরোধের কারণে লাখ লাখ টন গম, ভুট্টা, সূর্যমুখী তেল এবং অন্যান্য ইউক্রেনীয় পণ্য বিশ্ববাজারে প্রবেশ করতে পারছে না। রাশিয়া কর্তৃক অবরোধের আগে ইউক্রেনের ওদেসা ও মাইকোলাইভ থেকে শস্যগুলো রেলপথে প্রথমে বন্দরে নিয়ে যাওয়া হতো এবং তারপর এশিয়া, আফ্রিকা ও ইউরোপগামী জাহাজে তুলে রপ্তানি করা হতো। কিন্তু ফেব্রুয়ারির শেষ দিকে রাশিয়া ইউক্রেন আক্রমণ শুরুর পর থেকে বন্দরগুলো বন্ধ হয়ে যায়। এখন খুব অল্প পরিমাণ শস্য ট্রেনে করে প্রতিবেশী পোল্যান্ডে যায়। এ ছাড়া কিছু ইউক্রেনের দক্ষিণে অবস্থিত রোমানিয়া ও বুলগেরিয়ার বন্দর থেকে পাঠানো হয়। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভোলোদিমির জেলেনস্কি গত সপ্তাহে সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, শরৎকালে ইউক্রেনে ছয় কোটি টন শস্য আটকে যেতে পারে। সেগুলো শেষ পর্যন্ত পচে যেতে পারে।
করোনা মহামারি শুরুর পর থেকেই বিশ্বব্যাপী খাদ্যের দাম দ্রুত বেড়েছে। যুদ্ধবিধ্বস্ত ইউক্রেন থেকে রপ্তানি বাধাগ্রস্ত হওয়ার কারণে দাম আরো কয়েক ধাপ বেড়েছে। কিছু আফ্রিকার দেশের পাশাপাশি দক্ষিণ এশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন স্থানেও গুরুতর খাদ্যসংকটের ঝুঁকি তীব্র। মানবিক সহায়তার জন্য জাতিসংঘের সমন্বয়কারী মার্টিন গ্রিফিথস এই সপ্তাহান্তে টুইটারে লিখেছিলেন, বিশ্বজুড়ে দুর্ভিক্ষ প্রতিরোধের সমাধান কৃষ্ণ সাগরের বন্দরগুলো খুলে দেওয়া। টুইটে তিনি বলেছিলেন, ‘বিশ্বব্যাপী ক্ষুধা প্রতিরোধ করার সর্বোত্তম উপায় হলো বিশ্বজুড়ে খাদ্য নিরাপত্তা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে কৃষ্ণ সাগরের সব পথ খুলে দেওয়া।