ব্রিটিশ কারি অ্যাওয়ার্ডস’র প্রবর্তক এনাম আলী এমবিই আর নেই
স্টাফ রিপোর্টার :
প্রকাশিত হয়েছে : ১৭ জুলাই ২০২২, ১:৩০ মিনিটব্রিটিশ কারি অ্যাওয়ার্ডস’র প্রবর্তক, স্বনামখ্যাত ব্যবসায়ী এনাম আলী এমবিই আর নেই । রোববার ভোর ৩টায় যুক্তরাজ্যের সারের একটি হাসপাতালে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন। ইন্না-লিল্লাহি ওয়া ইন্না-লিল্লাহি রাজিউন।
১৯৬০ সালের ১ জানুয়ারি সিলেটে এনাম আলীর জন্ম। বাবা আলহাজ এম আলী। লেখাপড়া করতে ব্রিটেনে এসেছিলেন, ব্যবসায় মন থাকলেও লেখাপড়ার কথা ভুলে যাননি আলী। ১৯৯০ সালে রয়েল সোসাইটি অব আর্টস থেকে ফেলোশিপ পান। ব্রিটেনে ব্যবসায়ী হিসেবে খ্যাতি পেলেও ভোলেননি মাতৃভূমির কথা। ২০০৬ সালে সিলেটে গড়ে তুলেছেন সিলেট মহিলা মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতাল। শুধু এটাই নয়, ১৯৯১ সালে লন্ডনে প্রতিষ্ঠিত ব্রিটিশ-বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্সের (বিবিসিসি) প্রতিষ্ঠাতাদের একজন এই আলী।
মৃত্যুকালে তিনি স্ত্রী রুবী, মেয়ে জাস্টিন আলী ও দুই ছেলে জেফরি ও জাহিদকে রেখে গেছেন।
এক নজরে এনাম আলী এমবিই :
১৯৭৫ সাল। লেখাপড়ার জন্য ব্রিটেনে পাড়ি জমান বাঙালি তরুণ এনাম আলী। বিষয় ছিল হসপিটালিটি অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট। কিন্তু হাতখরচের জন্য কাজ নিলেন এক রেস্তোরাঁয়। আত্মীয়ের এক রেস্তোরাঁ ছিল। নাম ‘তাজমহল গ্রুপ রেস্টুরেন্ট’। সেখানে সপ্তাহে দুই দিন কাজ। ছুটির দিনগুলোতে। নিজের কথাগুলো বললেন এভাবে, ‘বিশেষত সেটারডেতে কাজ করতাম পকেটমানির জন্য। আমি স্বপ্নেও ভাবিনি রেস্টুরেন্টের মালিক হব এবং রেস্টুরেন্ট চালাব। পড়াশোনা শেষ করব এবং দেশে চলে যাব- এটাই ছিল আমার উদ্দেশ্য। কিন্তু এ উদ্দেশ্য থেকে সরে গেলাম। এ দেশেই থাকতে হলো এবং এখন আমি রেস্তোরাঁর মালিক। ‘ পড়াশোনা শেষ করতে করতেই রেস্তোরাঁ ব্যবসার খুঁটিনাটি দিকগুলো সম্পর্কে বেশ জানা হয়ে গেল। তখন চিন্তা করলেন, এ ব্যবসায় পুঁজি খাটালে নেহাত মন্দ হয় না। ব্যবসার ভবিষ্যতের দিকটিও ভেবে দেখলেন এনাম আলী। রেস্তোরাঁয় কাজ করার সময় দেখেছেন, মানুষ শুধু ভালো খাবারটাই প্রত্যাশা করে না, সঙ্গে সঙ্গে সেবা ও ভালো পরিবেশনাও চায়। এনাম আলী বলেন, ‘সবচেয়ে ভালো সার্ভিসটা দিলে মানুষ কিন্তু রেসপন্স করে। সব সময় বলে, ‘থ্যাংক ইউ ভেরি মাচ, ইউ আর ভেরি নাইস। ‘ পাশাপাশি ভোগান্তিরও কমতি ছিল না। ব্রিটেনে রেস্তোরাঁ গড়ে তোলা এবং পরিচিত করে তোলার জন্য ইন্ডিয়ান ও বাংলাদেশিদের অনেক কষ্ট পোহাতে হয়েছে। তখন গ্রাহকদের জ্বালাতনও সহ্য করতে হয়েছে। বিলেতি রেস্তোরাঁগুলো সাধারণত রাত ১২টায় বন্ধ হয়ে যেত। তবে এর পরও খোলা থাকত বাংলাদেশি ও ভারতীয় রেস্তোরাঁগুলো। কাস্টমাররা বিলেতি রেস্তোরাঁগুলোতে খেয়েদেয়ে এদেশীয় রেস্তোরাঁগুলোতে ঢুকত। আনন্দ-ফুর্তির জন্যই তারা এদেশীয় রেস্তোরাঁগুলো বেছে নিত। সাধারণত বসে বসে তারা ওয়াইন খেত। খাবারটা ছিল সেকেন্ডারি। ধীরে ধীরেই তারা এদেশীয় খাবারের সঙ্গে পরিচিত হয়েছে। ওয়াইনের পরিবর্তে একদিন খাবারটাই হয়ে উঠেছে প্রধান।
শুধু তা-ই নয়, আশির দশকের রেস্তোরাঁগুলো ইন্টেরিয়র ডিজাইনের ক্ষেত্রেও যে পিছিয়ে ছিল, সেটা লক্ষ করলেন এনাম আলী। তখন রেস্তোরাঁগুলোতে একটা সোজাসাপ্টা বিষয় ছিল- লাল কার্পেট, ওয়ালপেপার এবং খুবই অনুজ্জ্বল আলো। এটাই ছিল ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্টের প্রধান বৈশিষ্ট্য। এটা থেকে বের হয়ে এসে কিভাবে নতুন আঙ্গিকে রেস্তোরাঁয় নতুন পরিবেশ তৈরি করা যায়, সে চিন্তাও মাথায় রাখলেন। নিজের রেস্তোরাঁ গড়ার কথা বলতে গিয়ে বললেন, ‘এটাই ছিল আমার একটা ব্রেক থ্রু যে নিউ আঙ্গিকে রেস্টুরেন্ট, নিউ মিউজিক- সব কিছু মিলেমিশে ব্রেক থ্রু ফর ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্ট। ‘
ব্রিটেনের ১০ রেস্তোরাঁর একটি লি-রাজ
১৯৮৯ সালের নভেম্বরে এনাম আলী প্রতিষ্ঠা করলেন লি-রাজ রেস্তোরাঁ। এটি ব্রিটেনের ইপসম এলাকায় অবস্থিত। মূলত এর মাধ্যমেই তাঁর ব্যবসার জগতে প্রবেশ। সম্প্রতি গার্ডিয়ানের এক জরিপে ব্রিটেনের সেরা ১০ রেস্তোরাঁর একটি নির্বাচিত হয়েছে লি-রাজ। একমাত্র এশিয়ান রেস্তোরাঁ হিসেবে লি-রাজ হয়েছে ‘লা কনফ্রেরিয়ে দ্য লা চাইনে দাজ রেস্তোরাঁস’ সম্মাননার ভাগীদার। ২০১২ সালে লন্ডন সামার অলিম্পিক গেমসে সরকারি খাদ্য সরবরাহকারী হিসেবে নির্বাচিত হয় লি-রাজ।
কারিশিল্পে অবদান ও অন্যান্য
রেস্টুরেন্ট ব্যবসার পাশাপাশি এনাম আলী একাধিক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও সমাজসেবামূলক চ্যারিটির সঙ্গে যুক্ত। ব্রিটেন ও বাংলাদেশে রয়েছে তাঁর একাধিক ব্যবসা। লি-রাজ রেস্তোরাঁর মাধ্যমে যাত্রা শুরু হলেও তিনি ১৯৯২ সালে ডাইন বাংলাদেশি ক্যাম্পেইনের মাধ্যমে ব্রিটেনের রেস্তোরাঁ ব্যবসায় এক নবযুগের সূচনা করেন। ‘গিল্ড অব বাংলাদেশি রেস্টুরেন্টারস’ প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে ব্রিটেনের রেস্তোরাঁ জগৎকে সঠিক দিকনির্দেশনা এবং এর সমস্যা ও সম্ভাবনাকে তুলে ধরতে সক্ষম হন। আর এভাবেই ব্যবসায়িক সাফল্য ও ব্রিটিশ কারিশিল্পের উন্নয়নে নানা পদক্ষেপ আলীকে আলোচনার কেন্দ্রে নিয়ে আসে।
এনাম আলী টেরাক লিমিটেডের প্রধান উপদেষ্টাদের একজন। প্রতিষ্ঠানটি কাজ করছে জাতিসংঘের সঙ্গে। এর কাজ হলো, ২০১৫ সালের মধ্যে ১৫ মিলিয়ন ছাত্রকে কম্পিউটার বিলি করা। প্রযুক্তির ক্ষেত্রে এ প্রতিষ্ঠানটি কাজ করছে ইনটেল ও মাইক্রোসফটের সঙ্গে। ২০০৭ সালের আগস্ট থেকে আলী জড়িত আছেন দি ইউরোপিয়ান বাংলাদেশ ফেডারেশন অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ইবিএফ) সঙ্গে। তিনি সংগঠনটির প্রতিষ্ঠাতাদের একজন।